Menu
Categories
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গ্রিন বিল্ডিং
July 9, 2016 publications

জাহের ওয়াসিম ও একেএম হাসান জুলকার নাইন

fffজলবায়ু পরিবর্তন এখন বিশ্বের বহুল প্রচলিত এক শব্দযুগল। কল-কারখানা, বাড়িঘর থেকে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ শক্তি ও অন্যান্য কারণে ব্যাপক হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হচ্ছে। যার মধ্যে আছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরো-ফ্লুরো-কার্বন, ওজোন ও অন্যান্য গ্যাস। এসব গ্যাসের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ সর্বাধিক। পরিবেশ দূষণ ও গাছপালা কেটে ফেলার ফলেও গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে মেরু প্রদেশের বরফ গলে সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পেয়ে পৃথিবীর বহু জায়গা ডুবিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে উপকূলীয় অঞ্চল সর্বাধিক ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর প্রায় ১৪ মিলিমিটার সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ৫০ বছরে সমুদ্রের গড় উচ্চতা বেড়েছে ৩০০ মিলিমিটার। ১৯৯০-২০১৫ সালের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের সমুদ্র উপকূলের পানির উচ্চতা মেপে এই ফল পাওয়া যায়। গবেষকদের ধারণা, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে পানির উচ্চতা আরও বেড়ে যাবে এবং বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। বিশ্বে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ ৪৫ জনের মধ্যে একজন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। উদ্বেগজনক তথ্য এই যে, ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এরই মধ্যে কুতুবদিয়া এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষ মূল ভূখণ্ড ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের মূলে যত গ্রিনহাউস গ্যাসের ভূমিকা রয়েছে তার মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ভূমিকা সর্বাধিক। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত হচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে ৩৯ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে বাড়িঘর থেকে। বিশ্বে ব্যবহৃত মোট শক্তির ৪০ শতাংশই বিল্ডিংয়ে খরচ হয়। পৃথিবীর মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ৩ ভাগের ১ ভাগ বিল্ডিং থেকে নিঃসৃত হয় (সূত্র :ইউএসইপিএ)। এ ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর ভূমিকা বেশি হলেও বাংলাদেশের ভূমিকাও কম নয়। তাই বিল্ডিং থেকে যদি এই কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানো যায় তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে বড় ধরনের ভূমিকা রাখা যাবে। বিল্ডিংয়ের কার্বন নিঃসরণ কমাতে আধুনিক প্রযুক্তির যে ভবন রয়েছে তার নাম হলো ‘ গ্রিন বিল্ডিং’।

গ্রিন বিল্ডিংয়ে বিদ্যুৎ শক্তি কম ব্যবহার করে প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হয়। তাই বিদ্যুৎ খরচ ও কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বহুলাংশে কমে আসে। গ্রিন বিল্ডিংয়ে পানির অপচয় কমিয়ে সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। ব্যবহৃত পানিকে রিসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হয়। বৃষ্টির পানিকে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ট্যাংকের মাধ্যমে সংগ্রহ করে পরিশোধনের পর গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রিচার্জের ব্যবস্থা থাকে। পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য থাকে আধুনিক ব্যবস্থা। মনুষ্যনিঃসৃত বর্জ্য পরিশোধনের আধুনিক স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের ব্যবস্থা থাকে। পরিবেশবান্ধব কাঁচামাল ব্যবহার করা হয় নির্মাণকাজে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বাড়ির ছাদ ও বহিঃদেয়ালে তাপ নিরোধক উপাদান ব্যবহার করা হয়। যেমন, বাঁশ কিংবা নারিকেলের ছোবড়ার মতো প্রাকৃতিক নবায়নযোগ্য উপকরণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দিনের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ হ্রাস করা হয়। জানালায় বিশেষ ধরনের কাচ ব্যবহার করা হয়, যাতে দিনের আলো প্রবেশ করতে পারে কিন্তু তাপ কম প্রবেশ করে। সর্বোপরি একটি গ্রিন বিল্ডিংয়ের মূল কাজ হচ্ছে এনার্জি এফিশিয়েন্ট তথা কম জ্বালানি খরচের একটা স্থাপনা হিসেবে কাজ করা।

গ্রিন বিল্ডিংয়ের স্ট্যান্ডার্ড মান নির্ধারণে বিশ্বব্যাপী রয়েছে বিভিন্ন সংস্থা। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের ‘লিড’-এর সার্টিফিকেশন সবচেয়ে জনপ্রিয় ও মানসম্মত। তাদের বিভিন্ন চেকলিস্ট থাকে, যার প্রতিটির জন্য বরাদ্দ থাকে নির্দিষ্ট পয়েন্ট। এই পয়েন্টের ওপর ভিত্তি করে গ্রিন বিল্ডিংয়ের শ্রেণিবিভাগ হয়ে থাকে। মূলত চার ধরনের সনদ দেওয়া হয়ে থাকে_ ব্যাসিক সার্টিফিকেশন, সিলভার, গোল্ড ও প্লাটিনাম। সর্বনিম্ন ১০০০ বর্গফুটের যে কোনো ভবন নির্মাণে লিড সার্টফিকেশনের জন্য আবেদন করা যায়।

গ্রিন বিল্ডিংয়ের কার্যক্রম শুধু নতুন স্থাপনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। যে কোনো পুরনো স্থাপনাকেও রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে গ্রিন বিল্ডিংয়ে রূপান্তর করা যায়। তবে নতুন স্থাপনার জন্য কাজ যতটা সহজ, পুরনো স্থাপনার জন্য তা অনেক ক্ষেত্রে জটিল।

গ্রিন বিল্ডিং নির্মাণ করার ক্ষেত্রে অনেকেরই ধারণা থাকে, এটা খুবই ব্যয়বহুল। প্রকৃতপক্ষে একটা গ্রিন বিল্ডিং করতে গেলে মূল স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে শতকরা ৫ থেকে ৮ ভাগ পরিমাণ বেশি খরচ হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় গ্রিন বিল্ডিংয়ের জন্য বিশেষ হোম লোনের ব্যবস্থা আছে। সাধারণত হোম লোনের ক্ষেত্রে শতকরা ১২ ভাগ হারে সুদ দিতে হয়। কিন্তু গ্রিন বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে শতকরা ৫ থেকে ৮ ভাগ সুদে হোম লোন নেওয়া যায়। এতে বিশাল অঙ্কের আর্থিক সাশ্রয় হয়। অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব একটা স্থাপনা নির্মাণ করে সবুজায়নে বড় রকমের ভূমিকা রাখা যায়। গত ৬ জুন সমকালে প্রকাশিত হয়েছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, যেসব বাড়ির মালিক ছাদ, বারান্দা কিংবা বাসার সামনে বাগান করবেন তাদের হোল্ডিং ট্যাক্সের ১০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হবে। এটা খুব ভালো উদ্যোগ। বাসাবাড়িতে খোলা জায়গায় বাগান করে সহজেই এ সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।

ঢাকা শহর তথাপি বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও ভবনের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে সবুজায়নই একমাত্র জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সম্যক ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে জনসাধারণের পাশাপাশি নগর প্রতিনিধি ও নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে গ্রিন বিল্ডিংয়ের বিকল্প নেই।

 

লেখকদ্বয় : স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার
wasim@jaherwasim.com
jeweljulkernine@gmail.com

লেখাটি দৈনিক সমকালে ৩০ জুন ২০১৬ তে প্রকাশিত

লিংক-১  : http://bangla.samakal.net/2016/06/30/221713

লিংক-২ :  http://esamakal.net/2016/06/30/images/08_104.jpg

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

*