Menu
Categories
নব্বই দশকের খেলাধুলা
June 16, 2020 blog

৯০ এর দশকে এখনকার জনপ্রিয় ফুটবল, ক্রিকেট এবং বাডমিন্টনের  পাশাপাশি আমাদের খেলাধুলা বলতে ছিল ভিডিও গেমস। ভিডিও গেমসের দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতাম। এক টাকায় এক কয়েন। এক কয়েনে ১৫ থেকে ২০ মিনিট খেলা যেত নায়ক মারা যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। মোস্তফা সবচে’ বেশী জনপ্রিয় ছিল। যারা ভালো খেলতো তারা এক কয়েনে গেম ওভার করতে পারতো। যথারীতি বাবা-মায়েরা এই খেলার একদম ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তাই আমরা খুব লুকিয়ে লুকিয়ে খেলতাম।  

একবার জাফরাবাদের পুলপাড় মসজিদের কাছে এক দোকানে খেলছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে একজন নারীর কন্ঠ শুনলাম।

 “এই ছেলে এদিকে আসো”

খেলায় খুব মনোযোগী ছিলাম, তাই অপরিচিত কেউ ভেবে পাত্তা দিলাম না। আবার একই কণ্ঠ – “এই ছেলে তোমাকে ডাকছি শুনছোনা?”। এবার গলাটা পরিচিত ঠেকল। দোকানের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আম্মা। হাত পা অবশ হয়ে এল। আম্মার মেজাজ গরম হলে আমাকে নাম ধরে না ডেকে “এই ছেলে” বলে সম্বোধন করে। আম্মার হাতে একটা চিকন বেতের লাঠি। মারতে মারতে বাসায় নিয়ে গেলেন।

আম্মা বেশী মারতেন না, আব্বার কাছে মার খেয়েছি অনেক। তো সেদিন আম্মা অতীতের রেকর্ড ভংগ করে বেদম মারলেন আর প্রতিজ্ঞা করালেন আর যেন না খেলি। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে পারিনি, এমনই নেশা ছিল মোস্তফার। হাত খরচের টাকা যা পেতাম তার বড় একটা অংশই  চলে যেত মোস্তফার পিছনে।

ক্লাস সিক্সে উঠার পর নিজেকে খুব বড় ভাবা শুরু হল। আব্বার কাছে বায়না ধরলাম একটা সাইকেল লাগবে। মাঝারি সাইজের। আব্বা কিনে দিবো দিবো করে দিচ্ছেন না। এরপর অভিমান করে টানা দু’দিন না খেয়ে থাকলাম। অনেক জোরাজুরি করেও আমাকে খাওয়াতে পারলোনা কেউ।  হালের অনশন ধর্মঘট টাইপ ব্যাপার আর কি। তৃতীয় দিন আব্বা সাইকেল নিয়ে বাসায় আসলেন। পরে জানতে পারলাম এই দু’দিন আব্বা নিজেও কিছু খাননি আমার জন্য মন খারাপ করে।  

আব্বা সাইকেলের সাথে শর্ত জুড়ে দিলেন শুধুমাত্র বাসার কম্পাউন্ড আর ছাদে চালানো যাবে। বাইরে চালানো যাবেনা। অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে।

আব্বা যতক্ষণ বাসায় থাকতেন ততক্ষণ বাসার ভিতরে চালাতাম। আব্বা অফিসে যাওয়ার পরপরই সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে যেতাম। রায়েরবাজার, ধানমন্ডি, জাফরাবাদ , মোহাম্মদপুরের অলিগলি ঘুরে বেড়াতাম। একদিন খুব জোরে জোরে চালাচ্ছি। হাওয়ায়  ভাসছি একেবারে ।  আমার সামনে হঠাৎ করেই  একটা ট্রাক চলে আসল, ভীষন জোরে ব্রেক চাপলাম, ব্রেক ফেইল করে ট্রাকের পিছনের চাকায় মেরে দিলাম। সাইকেল সমেত রাস্তার একপাশে পড়ে গেলাম। সামনের চাকার রিং বাঁকা হয়ে গেল। কোনমতে পাড়ার দোকানে নিয়ে সাইকেল ঠিক করালাম। বাসায় কাউকে কিছু জানালাম না।

আমাদের বাসার সামনে একটা খালি জায়গা ছিল, উঠানের মত। দোতলা বাড়ির নিচতলায় থাকতাম আমরা। এই উঠানের নিচে ছিল বিল্ডিংয়ের আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার ট্যাংক। ট্যাংকের কাস্ট আয়রনের ম্যানহোল এ সবসময় একটা তালা দেয়া থাকতো। ট্যাংক খালি হলে দোতলা থেকে বাড়িওয়ালা আংকেল পানির সুইচ অন করে দিতেন। আমি ম্যানহোলের উপর কান পেতে ট্যাংকের মধ্যে পানি পড়ার শব্দ শুনতাম। কল কল একটা শব্দ। খুব ভালো লাগত। একদিন দেখলাম ম্যানহোলের ঢাকনায় তালাটা নেই। আমি ঢাকনাটা উঠিয়ে ভিতরে তাকিয়ে দেখছিলাম। ভিতরে খুব অন্ধকার। পানি টলমল করছে। আরেকটু ভিতরে ঢুকিয়ে দিলাম মাথা। ওভারটার্ন করে পুরো শরীর ট্যাংক এর মধ্যে ঢুকে গেল। আমি দুই হাত দিয়ে কোনমতে ম্যানহোলের ঢাকনার সাইড টাকে ধরে ফেললাম । অভিকর্ষ বল পুরো শরীরটাকে নিচের দিকে টানছে। ভিতরে গভীর অন্ধকার। পড়ে গেলে ডাকলেও কেউ শুনবেনা। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। দশ ফিট এর মতো গভীর এই ট্যাংক এ পড়ে গেলে বাঁচার কোন সম্ভাবনা নেই। তখনো সাঁতার শেখা হয়নি। অনেক কষ্ট করে দুই হাত দিয়ে ম্যানহোলের গায়ে ধাক্কা দিয়ে নিজের শরীরটাকে উপরে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করলাম। হাত বারবার পিছলে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টার পর  মাথাটা ট্যাংকের বাইরে বের হয়ে আসল। হাতের চারপাশ ছিলে গেল। শরীরটাকে আরেকটু বের করে আনলাম। ঘেমে নেয়ে একাকার। ট্যাংকের বাইরে বেরিয়ে আসলাম। একদৌড় দিয়ে বাসায় ঢুকে নিজের রুমে দরজা লাগিয়ে শুয়ে রইলাম। আম্মা কিচেনে ছিল, তাই কিছু বুঝতে পারেনি।  প্রচন্ড বুক ধড়পড় করছিল। একটা ট্রমার মধ্যে ঢুকে গেলাম। বিছানায় শুয়ে আছি। মনে হচ্ছে পুরো রুমটা পানি দিয়ে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে আমি সেই পানিতে ডুবে যাচ্ছি, তলিয়ে যাচ্ছি। পানির প্রতি একটা ভীতি তৈরী হল। তো সেই ভীতি কমাতে সাঁতার শেখা শুরু করলাম।

স্কুলের বন্ধুরা মিলে সবাই ঘুরতে যেতাম ধানমন্ডি লেকে। সুব্রত নামে এক বন্ধু ছিল , ও বলল চল পানিতে নামি। আমি বললাম আমি সাঁতার পারিনা। ও আশেপাশের এক  টোকাইয়ের কাছ থেকে শোলা কিনে নিল। বলল, “এইটা ধরে ভেসে থাকবি। তাহলে আর ডুববি না”। তো এই শোলা নিয়ে দুরুদুরু বুকে সাতাঁর শেখার শুরু ধানমন্ডি লেকের ঈষৎ কালো নোংরা পানিতে। এভাবে সাতার শেখা হয়ে গেল বেশ কিছুদিন পর। পানি ভীতি কমল কিছুটা। মাঝে মধ্যে আমরা বুড়িগঙ্গার পানিতে সাঁতার কাটতে যেতাম। ফিজিক্যাল মোড়ে একটা ওপেন সুইমিংপুল ছিল। ওখানেও আমরা সাঁতার কাটতে যেতাম। ওখানে বিভিন্ন হাইট থেকে লাফ দেয়া যেত। ৫ মিটার , ৭.৫  মিটার ও ১০ মিটার উচ্চতায় জাম্পিং বোর্ড ছিল । আমি ৫ মিটারের বেশী উপর থেকে পারতাম না প্রবল উচ্চতা ভীতির কারনে। এই উচ্চতা ভীতির কারনে আমি এখনো কোন বিল্ডিংয়ের ছাদ ঢালাইয়ের আগে সাইট ভিজিট করতে  গেলে বুক ধড়পড় ধড়পড় করে। দশ তলার বেশী উচ্চতা থেকে নিচে তাকাতেই পারিনা।

তো একবার এক ছেলে ১০ মিটার উচ্চতা থেকে লাফ দিল। ডাইভারদের মত একটু স্টাইল করে দুই হাত মাথার উপরে নিয়ে একসাথ করে ডাইভ দিল।  কিন্তু ও পানিতে পড়ল ভূলভাবে। নিচে পড়তে পড়তে শরীর মোচড় খেয়ে গেল।  খাড়াভাবে না পড়ে ভূমির সমান্তরালে পড়ল মুখ ধুবড়ে। ওর বুক, পেট আর মুখ পানিতে এসে পড়ল বিশাল ফোর্স নিয়ে। নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে গেল। প্রায় ২০ ফিট গভীর পুলে তলিয়ে গেল। অনেক চেষ্টায় ওকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হল। সেই পুলে আমার আর কখনো যাওয়া হয়নি।

বাসায় কোন গেস্ট বাচ্চা নিয়ে আসলে আনন্দের শেষ থাকতোনা। তাকে নিয়ে বাকী দোকান থেকে ইগলুর কাপ আইসক্রিম খেতাম। আট টাকা ছিল দাম সম্ভবত। আইসক্রিম খাওয়ার চেয়েও মূল উদ্দেশ্য থাকত অন্য।  কাপ দিয়ে টেলিফোন বানাতাম। দুইটা কাপ এর পিছনে একটা করে ছিদ্র বানিয়ে বড় একটা লম্বা সুতা দিয়ে জুড়ে দিতাম। তারপর দুইজন দুই প্রান্ত থেকে সেই কাপের ভেতর দিয়ে কথা বলতাম। দড়ির মধ্য দিয়ে কথা ভেসে আসতো বলে মনে হত। অন্যরকম একটা অনুভূতি ছিল। এই হালের মোবাইল ফোন যে আমাদের যোগাযোগের ব্যাপারটা কিরুপ আমূল বদলে দিয়েছে তা ভাবাই যায়না।

বাসার খাট আর টেবিলের মাঝখানে একটা কাঠের তক্তা দিয়ে ব্রীজ বানাতাম। তক্তাটাকে খাটের আর টেবিলের সাথে দড়ি দিয়ে বেধে নিতাম।  একপ্রকার সিমপ্লি সাপোর্টেট ব্রীজ। সেই ব্রীজের উপর হাঁটতাম। টেবিলের উপর থেকে খাটে, আবার খাট থেকে টেবিলে।  তো একবার সেই ব্রীজের উপর থেকে পিছলে পড়ে খাটের কোনায় মাথা ফাঁটিয়ে ফেললাম। রক্তারক্তি কান্ড। তিনটে সেলাই পড়ল কপালে। হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে আব্বা বলল, তোমার মায়ের সাথে একটা ছবি তুলে রাখ। মাথাতো আর ডেইলী ফাঁটেনা। একটা স্মৃতি থাকুক। সেই ছবি এখনো আমার বাসার দেয়ালে টাংগানো আছে। তো এই ঘটনার পর থেকে দুইটা তক্তা দিয়ে ব্রীজ বানিয়ে দুইটার উপর দুই পা দিয়ে হাঁটতাম। ব্রীজের রিডান্ড্যান্সী বেড়ে গেল। ফেইলিউর এর চান্স কমল।  প্রাচীনকাল থেকে প্রকৌশল বিদ্যা এইভাবে ফেইলিউর থেকে শিক্ষা নিয়ে নিয়েই ডেভেলপ করেছে, হাহাহা।

আমাদের বাসা ছিল পশ্চিম ধানমন্ডির ঢালাইকারখানায়। বাসার সামনে সবসময়ই নতুন বিল্ডিং এর কনস্ট্রাকশন হত। ট্রাকে করে বালু এনে স্তুপ করে রাখতো। বাসায় পুরাতন কোন নষ্ট স্পীকার থাকলে ওটার ভেতর থেকে ম্যাগনেট খুলে নিয়ে নিতাম। তারপর সেই ম্যাগনেট নিয়ে বালুর ঢিবির উপরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আয়রন কালেক্ট করতাম। তারপর সব আয়রন একটা সাদা কাগজে নিয়ে কাগজের একটু নিচে ম্যাগনেট ধরে সেটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেক প্যাটার্ন তৈরী করা যেত। খুব মজার একটা খেলা ছিল। তো একদিন বালুর ঢিবিতে বসে বসে আয়রন কালেক্ট করছি। অদূরেই বিল্ডিংয়ের পাইলিং এর কাজ হচ্ছে। ট্রাইপড দিয়ে পাইলের হোল ড্রিলিং করছে। বিশাল সাইজের তিনটা মেটাল পাইপ দিয়ে একটা পিরামিডের মত বানিয়ে তার মাঝখান থেকে  ভারী একটা জিনিস ঝুলিয়ে অনেক উপর থেকে তা কিছুক্ষ্ণ পরপর  ফেলে ফেলে পাইলিং এর কাজ চলছে। হঠাৎ  বিকট শব্দ হল। ট্রাইপড ফেইল করেছে স্লিপ করে। আমরা সবাই দৌড় দিলাম। ট্রাইপড এসে পড়ল একটা কনস্ট্রাকশন এক অল্পবয়েসী ওয়ার্কারের গায়ে। ঘটনাস্থলেই মারা গেল ছেলেটা। প্রচন্ড রকমের আতংক ভর করল মনে। আমি আজও আমার ডিজাইন করা কোন বিল্ডিংয়ের পাইলিং এর কাজ চেক করতে গেলে আতংকে থাকি – যদি ট্রাইপড ফেইল করে গায়ে পড়ে!

ছোটবেলার এইরকম হাজারটা গল্প আছে।বাবা অনেক শাসন করতেন, মা কিছুটা ছাড় দিতেন। বাবা মায়ের শাসনকে মাঝে মধ্যে খুব অতিশাসন বলে মনে হত। ভাবতাম আরেকটু স্বাধীনতা দরকার। এখন ভাবি আমার ছেলেকে কি আমি অতোটুকু স্বাধীনতা দিব কিংবা দিতে পারবো, যতোটুকু আমি নিজে চেয়েছিলাম? প্রশ্নের উত্তরটা এখনো পাইনি।  

Comments are closed
*