কোয়ারেন্টিনের উপলব্ধি

এই যে আমরা কোয়ারেন্টিনে আছি, সবসময় একটা শংকার মধ্যে থাকতে হয় কখন কি হয়। অনেক রকম ভয়, অনিশ্চয়তা আমাদের ঘিরে ধরে। দেশের কি হবে, সাধারন মানুষের কি হবে, অর্থনীতির কি হবে, ক্যারিয়ার কোন দিকে মোড় নিবে ইত্যাকার চিন্তা।

এতো নেগেটিভিটির মধ্যেও কিছু পজেটিভ ব্যাপার আছে। আমরা যারা আমাদের ক্যারিয়ার নিয়ে/অফিসের কাজে এতোদিন ব্যস্ততম সময় কাটিয়েছি এখন একটু অবসর মিলছে। একটু ডীপ থিংকিং এর সুযোগ হচ্ছে। কিছু পেশা আছে যাদের ৯ টা – ৫ টা অফিস টাইম বলে কিছু থাকেনা। যেমন, ডাক্তার, পুলিশ, সাংবাদিক, ইউটিলিটি সার্ভিস প্রোভাইডার ইত্যাদি। সবাইকেই তার নিজের কাজটাতে বেস্ট আউটপুট দিতে হয়।

আমার নিজের ক্ষেত্রে একজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমার রুটিন ৯-৫ টা অফিস শেষ করার পর বাসায় এসে নিজের পার্সোনাল প্রজেক্টের কাজ করতে হয়। ডিজাইনের কোড নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে হয়। ছুটির দিনে কনফারেন্স, টেকনিক্যাল সেমিনার, ওয়ার্কশপ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট রিসার্চ, পাবলিকেশন, নতুন স্ট্রাকচারাল ফর্ম নিয়ে ভাবা, ডিজাইন রিপোর্ট তৈরী করা, নতুন কোন বই পড়া এসবে সময় কেটে যায়। বাকী সময় যায় ভাবতে যে, যেসব ডিজাইনে সাইন করেছি সব ক্যাল্কুলেশন ঠিক ছিল কিনা। যদি আমাদের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন কয়েকটা লেভেলে পিয়ার রিভিউ হয়ে ফাইনাল সাবমিশন হয়। তাও অনেক অনিশ্চয়তা থাকে। সাইটে ডিজাইন মোতাবেক কাজ হল কিনা। মিস্ত্রী ভূল করল কিনা। ম্যাটেরিয়ালের স্ট্রেংথ ঠিকমত আসল কিনা। কারন এখানে মানুষের জীবন জড়িত। ভূলের কোন সুযোগ নেই। এক রানা প্লাজা কলাপ্স করে সহস্রাধিক মানুষ মারা গেছে। তাই কোন প্রবল ঘূর্নিঝড়/কালবৈশাখী হলে চিন্তা হয় আমার ডিজাইন করা বিল্ডিং গুলা ভালোভাবে পারফর্ম করল কিনা। উইন্ড এর জন্য আমরা ইলাস্টিক ফোর্স ধরে ডিজাইন করি তাই আন্সার্টেনিটি কম। কিন্তু ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ইনইলাস্টিক ডিফরমেশন এর সম্ভাবনা থাকে। যা ম্যাটেরিয়াল/ সিস্টেমের ডাক্টিলিটি এর উপর নির্ভর করে। তাই আনসার্টেনিটি বেশী থাকে। চট্রগ্রাম , সিলেট বা ময়মনসিংহ, শেরপুরের মত ঝুকিপূর্ন এলাকায় কোন ভূমিকম্প হলে আমার ডিজাইন করা বিল্ডিং গুলার মালিকদের ফোন করে খবর নেই । সাইসমিক রেস্পন্স কেমন ছিল। কোন মেজর প্রবলেম হয়েছে কিনা। একটা স্ট্রেস থাকে। তবে এর মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। নিজে কিছু সৃষ্টির আনন্দ। আকাশ ছুতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। মানুষের তিনটি মৌলিক চাহিদার একটি হল ব্যবস্থান – যা নিরাপদ ও কম খরচে তৈরীতে আমরা অবদান রাখতে পারি। গনিত ও পদার্থবিজ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ হয় প্রত্যেকটা ডিজাইনে। এই কারনে বুয়েট থেকে পাশ করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যত কষ্টই হোক স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ক্যারিয়ার করবো। এই কঠিন পথে আমার পাশে ছিল সবসময়ের সংগী আমার স্ত্রী। ওর সাপোর্ট না থাকলে এটা একপ্রকার অসম্ভব ছিল। আর্থিক ও সামাজিক চাপ ছিল একটা দীর্ঘ সময়। তো ধীরে ধীরে নিজের কাজে এতোই ডুবে গেলাম যে সংসারের কাজে সময় দেয়ার সময়টুকু আর পেলামই না।

কিন্তু লকডাউনের এই অখন্ড অবসরে এতটুকু বুঝতে পারছি যে সংসার চালানো কতোটা সফিস্টিকেটেড একটা কাজ। এতোদিন মনে হত শুধু রান্না-বান্না আর ঘর পরিষ্কার রাখাই মনে হয় সংসারের কাজ। কাজগুলো যে খুব কষ্টসাধ্য তা বুঝতাম । কিন্তু এখন বুঝতে পারছি কতটা কঠিন সংসার সামলান। হাজারটা কাজের কথা বলা যেতে পারে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নামাজ পড়া, কোরআন তেলাওয়াত/ নিজ নিজ ধর্মের প্রার্থনা। আমি জাস্ট কয়েকটার কথা বলব যেগুলো কত কয়েকদিন ধরে আমি আমার ওয়াইফকে করতে দেখছি। কিছু কাজে নিজেও হাত লাগানোর চেষ্টা করছি।

১। ঘর ঝড়ু দেয়া
২। ঘর মোছা
২। বাথরুম ক্লীন করা
৩। কাপড় ধোয়া
৪। বারান্দা পরিষ্কার করা
৫। জানালার গ্রীল পরিষ্কার করা
৬। সিলিং ফ্যান মোছা
৭। কিচেনের এক্সস্ট ফ্যান পরিষ্কার করা
৮। খাটের নীচটা ক্লীন করা
৯। বেসিন মাজা
১০। সিংক মাজা
১১। চুলা পরিস্কার করা
১২। হাড়ি-পাতিল ধোয়া
১৩। ওভেন পরিস্কার করা
১৪। ওয়াশিং মেশিন এর ময়লা পানি ফেলা
১৫। ফ্রীজ পরিষ্কার করা
১৬। ফার্ণিচার মোছা
১৭। প্রতিদিন ময়লা ফেলা
১৮। দেয়ালঘড়ির ব্যাটারী পরিষ্কার করা
১৯। ক্যালেন্ডারের পাতা উলটানো
২০। পর্দা ধোয়া
২১। বাজার কাটাকাটি করে ফ্রীজাপ করা
২২। রান্নার আগে সব বাজার কেটেকুটে রেডি করা।
২৩। বাচ্চাকে খাওয়ানো
২৪। বাচ্চাকে গোসল করানো
২৫। বাচ্চাকে ক্লীন করা
২৬। বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানো
২৭। পানি সেদ্ধ করা
২৮। পানি পিউরিফায়ারে ঢালা
২৯। পানি বোতলে ভরা
৩০। বারান্ধা থাকে শুকনা কাপড় এনে ভাজ করা…

এই লিস্ট কখনো শেষ হওয়ার নয়। হ্যা সব কাজ প্রতিদিন করতে হয়না। আবার সব কাজের কষ্টও সমান নয়। কিন্তু প্রত্যেকটা কাজই পারফেক্ট ভাবে করতে হয়। আমাদের মায়েরা – স্ত্রীরা গৃহকর্মীর সহায়তা নিয়ে বা ছাড়াই কিভাবে এগুলো মেইন্টেইন করেন আমি জানিনা।

ছোটবেলায় মিনা কার্টুন খুব পছন্দ ছিল। থিম সংটা শুনলেই টিভির সামনে চলে আসতাম। একটা পর্ব ছিল রাজু তার বোন মিনাকে বলছে- মিনার কাজ খুব সোজা, তার কাজ অনেক কঠিন।
তখন মিনা বলল, তাহলে আমরা বদলা-বদলি করিনা কেন ?
পরেরদিন মিনা রাজুর সব কাজ করল। আর রাজু মিনার দুয়েকটা কাজ করেই হাঁপিয়ে উঠল। সে বুঝতে পারলো কতটা কঠিন ঘরের কাজ।

সত্যিই আমি খুব অবাক হচ্ছি আমাদের মায়েরা-বোনেরা-স্ত্রীরা কিভাবে এতো মাল্টি-টাস্কিং করেন ? তাও আবার হাসিমুখে। বিনাশর্তে। কোন অভিযোগ ছাড়াই। অবভিয়াসলি বিনা বেতনে!
উন্নত দেশে নারী পুরুষ তাদের ঘরের কাজ ভাগাভাগি করে নেন। কারন গৃহকর্মীর অপশন নেই। আমাদের উপমহাদেশে এই চলটা কম। আপনার প্রিয়জনকে এই কোয়ারেন্টিনের লকডাউনে কোন উপহার দিতে চাইলে তার কাজে কিছুটা সহায়তা করুন। এর চেয়ে বড় উপহার আর কিছুতেই হয়না