বর্ষা বিড়ম্বনা

rainবর্ষাকাল আমার কাছে চরম বিরক্তিকর একটা ঋতু। কারন বর্ষাকাল সবার কাছে আনন্দের ঋতু হয়ে এলেও আমার কাছে আসে ঝাড়ির ঋতু হয়ে। আমি আর আব্বু ছোটবেলায় একসঙ্গে বাজার করতে যেতাম। রায়ের বাজার কাচাঁবাজার। জায়গাটা খুব নোংরা। তার উপর বৃষ্টি বাদল হলে আরো নোংরা হয়ে থাকত। বৃষ্টি হবার পর রাস্তাটা থঁকথঁকে হয় যেত। আমি একটু পা ঘষে ঘষে হাঁটতাম। রাস্তায় হাটঁতে গেলেই আমার প্যান্টের পেছনটা কাঁদার ছিটা পড়ে ভরে যেত। আব্বু আমাকে ঝাড়ি দিয়ে বলত, ‘বলদের মত হাটঁস ক্যান? প্যান্ট ভরছে কেমনে? মাটির সাথে পা ঘইষা ঘইষা হাঁটবি না। তুই কি এখনো ছোট বাচ্চা যে তোরে এসব শিখাইতে হবে?’।
আমি যথেষ্ট ছোটই ছিলাম। ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়তাম। আব্বুর বকা খেয়ে খেয়ে দ্রুত নিজেকে বড় করার চেষ্টা শুরু করলাম। গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতুতেই মাটির সমান্তরালে পা তুলে তুলে হাঁটা অভ্যাস করলাম। ফলে আমার স্বাভাবিক হাঁটার গতি কমে গেল। যেকোন জায়গায় যেতে অনেক দেরী হয়ে যায়। ক্লাসে দেরীতে যাই, ম্যাডামের বাসায় পড়তে যেতে দেরী হয়ে যায় এবং যথারীতি আবার ঝাড়ি খেতে লাগলাম। একসময় আমার কাছে মনে হতে লাগল আমি এখন আর বলদ পর্যায়ে নাই, আমি পাপোস হইয়ে গেছি। পাপোসের উপর সবাই পা মুছে আর আমাকে সবাই ঝাড়ে। এই হল আমার অবস্থা । সুতরাং বর্ষাকাল আমার কাছে কখনোই সুখ স্মৃতি নিয়ে আসেনি ।

শিশুকালেই নিজের মধ্যে মহান কাব্য প্রতিভা দেখে একখানা কাব্য লিখতে বসে গেলাম। কাকতালীয় ভাবেই বর্ষা নিয়ে। বর্ষাকে অপছন্দ করলে পাঠ্যপুস্তকের কবিতাগুলো পড়ে মনে হয়েছে নিজের অপছন্দ নিয়ে কোন কবিতা লেখা যাবেনা। কবিতায় সবসময় ভালো কথা বলতে হবে। খুব ভালো কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মনে যা আসে তা নিয়েই কবিতা রচনায় বসলাম।
‘টুপটাপ টুপটাপ বৃষ্টি ঝরছে
কাকে যেন অসময়ে খুব মনে পড়ছে-
… … …
মহাকাব্যখানা (!) রচনা করেই মাসিক আদর্শ নারী নামক একটা ম্যাগাজিনে পাঠিয়ে দিলাম। আমাদের ফ্যামিলিটা খুব ধার্মিক হওয়ায় বাসায় প্রতিমাসে আদর্শ নারী রাখা মোটামুটি ফরজ ছিল। উপদেশমূলক ছোটগল্প, গজল, ইসলামী কবিতা ছাপাতো ওরা। নিশ্চিত ধরে নিলাম আমার কবিতা ছাপানো হবে। প্রায় ছয়মাস অপেক্ষা করেছিলাম ছাপানোর জন্য। কিন্তু ছাপাল না। চরম হতাশ হয়ে কবিতা লেখা ছেড়ে দিলাম। মাসিক আদর্শ নারী পড়াও ছেড়ে দিলাম।

ইদানীং কালে বৃষ্টি দেখলে মাঝে মধ্যে ভিজতে টিজতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এখন আবার নতুন যন্ত্রনা শুরু হয়েছে সেটা হচ্ছে মোবাইল ফোন। রাস্তা দিয়ে হাঁটতেছি হঠাৎ বৃষ্টি নামল। সাথে সাথে আমাদের মূল টার্গেট থাকে বৃষ্টির পানি থেকে নিজের মূল্যবান মোবাইলখানা রক্ষা করা । সুতরাং ভিজার প্রশ্নই উঠেনা। ওয়াটারপ্রুফ ঘড়ি পাওয়া যায়, এখন ওয়াটার প্রুফ মোবাইল দরকার । তাহলে বর্ষাকালে রাস্তাঘাটে শান্তিমত ভিজা যেত। এই মোবাইলখানা এমনিতেই জীবনের সব স্বাধীনতা হরণ করে নিয়েছে তার উপর এখন বৃষ্টিতে ভিজার আনন্দতেও বাগড়া দেয়।

আমার বন্ধুদের কাছে বর্ষাকাল মানে বিশাল আনন্দের ব্যাপার- বৃষ্টির মধ্যে রিকশার হুড ফেলে ঘোরা যাবে। ওদের কাছে শুনে শুনে আমারো ইচ্ছা হল রিকশায় হুড তুলে ঘুরি একদিন। ঘুরলেতো আর একা একা ঘোরা যায়না সঙ্গী লাগে। তো একদিন ক্লাস শেষে বাসায় ফিরব- দেখি বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। কলেজের বন্ধু সেজুতিকে বললাম, চল রিকশায় করে ঘুরি। ও বলল, ‘ঘুরাতো যায় কিন্তু তোরে নিয়ে ঘুরবে কোন পাগলে’। আমি ভাঁবাচাকা খেয়ে গেলাম। ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চল যাই, মুখটা যেরকম বানাইছস মনে হচ্ছে বেহেশত মিস হয়ে গেছে’। একটা রিকশায় উঠে হুড তুলে দিলাম। আমার হাইট একটু বেশি হওয়ায় আমি পিঠ আর ঘাড় বাঁকা করে কোনমতে বসলাম। এবং ব্যাপারটা মোটেই আনন্দদায়ক বলে মনে হচ্ছে না। যেকোন সময় পেছন থেকে একটা রিকশা এসে ধাক্কা দিলেই আমি ভারসাম্য হারিয়ে সামনে পড়ে যাব। সেজুতি বলল, ‘কিরে তুই ঘাড় বাঁকা করে রাখছিস কেন’? আমি বললাম, বসতে পারছি না। ও বলল, ‘ধুর গাধা নাম। তোর রিকশায় ঘোরার দরকার নাই’।
মন খারাপ করে বাসায় চলে এলাম। ছোট বেলায় আব্বুর কাছে বলদ উপাধি পেয়েছিলাম। মাঝখানে ভাবছি মানুষ হয়ে গেছি। এখন দেখতেছি হয়েছি গাধা। বলদ থেকে গাধা। ভালোই বিবর্তন খারাপ না। বর্ষা আনন্দ না দিলেও কিছু বিবর্তন দিয়েছে। তাই বা কম কী?

Leave a Reply