ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ, আমরা কতোটুকু প্রস্তুত?

সভ্যতার শুরু থেকেই প্রাকৃতিক শক্তিগুলো মানুষের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে সবসময়। কিন্তু মানুষ সবসময় প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রন করে তার সাথে সহাবস্থান করার চেষ্টা করেছে। যত ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগ রয়েছে যেমন- বন্যা, ঘূর্নিঝড়, টর্নেডো, খরা, ভূমিকম্প, অগ্লুৎপাত – এদের মধ্যে সবচেয়ে ধ্বংসাত্নক ও অনিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ভূমিকম্প। যদিও অন্যান্য দূর্যোগে একসাথে আরো বেশী মানুষের প্রাণহানি হয়, কিন্তু ভূমিকম্পের অকস্মাৎ ও অনাকাংক্ষিত আঘাত সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিপূর্ন অবস্থার সৃষ্টি করে।

পৃথিবীর বহির্ভাগ বেশ কিছু বিশাল আকৃতির পাথরের প্লেট দ্বারা আবৃত। এই প্লেটগুলোকে টেকটোনিক প্লেট বলে। এই প্লেটের মধ্যবর্তী ফাঁটল দ্বারা এগুলো আলাদা থাকে। এক একটি প্লেটের গভীরতা ১০০-২০০ কিলোমিটারের সমান। এই প্লেটের উপরিভাগ হচ্ছে পৃথিবীর উপরের শক্ত পাথুরে আবরন যাকে ক্রাস্ট বলা হয়। অভিকর্ষীয় বল, পৃথিবীর ঘূর্ণনজনিত বল ও পৃথিবীর কেন্দ্রের কোরের তাপের পরিচলনের কারনে একটা প্লেট সবসময় অন্যটিকে ধাক্কা দিতে থাকে। ফলশ্রুতিতে প্লেটগুলোর সংযোগস্থলে স্ট্রেস ও স্ট্রেইন এনার্জি তৈরী হয়। এই স্ট্রেইন এনার্জি যখন প্লেটগুলোর ঘর্ষনজনিত প্রতিরোধের চেয়ে বেশী হয়ে যায় তখন একটা প্লেট আরেকটার সাপেক্ষে সরে যায় এবং বিশাল শক্তি ত্যাগ করে। তা থেকে উৎপত্তি হয় ভূ-কম্পনের।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান যথাক্রমে ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে। সমুদ্রের কাছাকাছি হিমালয়ী নদী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এবং অহিমালয়ী নদী মেঘনার সহযোগে সৃষ্ট বিশ্বের সর্ববৃহৎ বদ্বীদের কারনে ভূমিকম্পের পরে সুনামি ও বন্যারও ঝুঁকি রয়েছে।

ভূমিকম্পের দোলনের কারনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিল্ডিং, ব্রীজ ও অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো সমূহ। সেই কারনে পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশেই এসব অবকাঠামোর নকশা প্রনয়নের কোডে ভূমিকম্পের কারনে সৃষ্ট বিকৃতির জন্য যথাযথভাবে স্থাপনা নির্মাণের জন্য দিকনির্দেশনা রয়েছে।

বাংলাদেশের ভবন নির্মাণ ১৯৫২ সালের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট এর আইনী কাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এর ভিত্তিতে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হয় ১৯৯৩ সালে এবং এতে ১৮এ নতুন উপধারা যুক্ত করে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একটি আইনী কাঠামোতে আনা হয়। পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত দেশে বিল্ডিং কোড সাধারনত দুই থেকে তিন বছর পরপর সম্পাদিত করে নতুন সংস্করন বের করা হয়। কারন সারা বিশ্ববাপী প্রতিনিয়ত ছোট-মাঝারি-বড় মাত্রার বিভিন্ন ভূমিকম্প হয়ে থাকে। প্রত্যেকটি বড়মাত্রার ভূমিকম্পের পর দেখা যায় কিছু স্থাপনা তৎকালীন বিল্ডিং কোড মেনে ডিজাইন করার পরেও সেগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তখন গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে স্থাপনাকে অধিকতর ভূমিকম্প ও অন্যান্য দূর্যোগ সহনশীল করার জন্য কোডে পরিবর্তন আনা হয়। আবার বিল্ডিং নির্মাণ সামগ্রীর গুনগত মানের পরিবর্তন, আধুনিক, দীর্ঘস্থায়ী ও পরিবেশবান্ধব নতুন উপকরনের সংযোজনের জন্যও বিল্ডিং কোডের নতুন সংস্করণ আনা হয়।

বাংলাদেশে ২০০৬ সালের বিল্ডিং কোড গ্যাজেটেড হওয়ার পর বেশ কিছু বছর পর থেকে নতুন সংস্করনের কাজ শুরু করা হয়। যা অক্টোবর ২০২০ সাল অবধি এখনো গ্যাজেটেড আকারে প্রকাশিত হয়নি। গণমাধ্যমসূত্রে জানা যাচ্ছে যে অতিশীঘ্রই তা প্রকাশিত হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাপক মাত্রায় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে যার মধ্যে রয়েছে সুউচ্চ ভবন, ব্রীজ, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল ও অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভৌত অবকাঠামো । বড় মাত্রার ভূমিকম্পের জন্য দীর্ঘস্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই সর্বাধুনিক বিল্ডিং কোডের অনুমোদন দিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।

পৃথিবীর যেকোন দেশে কোন স্থাপনা নির্মাণ করতে গেলেই তা নির্দিষ্ট এখতিয়ারভূক্ত অঞ্চলে নিবন্ধিত ও যথাযথ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন স্থপতি এবং প্রকৌশলীর সহায়তায় নকশা প্রনয়ন করতে হয়। এক্ষেত্রে একজন স্থপতি বা আর্কিটেক্ট তার স্থাপত্যের জ্ঞান প্রয়োগ করে বিল্ডিংয়ের কার্যবিধি, গঠন, নান্দদিকতা ও প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের চাহিদা বিবেচনা করে একটা স্থাপত্য নকশা প্রনয়ন করেন। একজন কাঠামো প্রকৌশলী কিংবা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার তার পদার্থবিদ্যা, বলবিদ্যা ও গাণিতিক সমাধানের জ্ঞান প্রয়োগ করে এমনভাবে কাঠামো নকশা বা স্ট্রাকচারাল ডিজাইন প্রনয়ন করেন যেন বিল্ডিংয়ের নিজের ভর, ব্যবহারের কারনে আরোপিত ভর, বাতাস/ঘূর্নিঝড়ের কারনে সৃষ্ট চাপ , মাটির চাপ, বন্যার পানির চাপ ও ভূমিকম্পের দোলনজনিত বলের কারনে সৃষ্ট বিকৃতিতে বিল্ডিং ধ্বসে না পড়ে ও ব্যবহারের জন্য উপযোগী থাকে তা নিশ্চিত করেন। বিল্ডিংয়ের পানি সরবরাহ, বর্জ্য নিষ্কাশন, বিদ্যুৎ সরবরাহ, অগ্নি সহায়ক ব্যবস্থার নকশা প্রনয়ন করেন পুরকৌশলী, তড়িৎকৌশলী ও যন্ত্রকৌশলীর সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ দল। একটা ভূমিকম্প সহনশীল স্থাপনা নির্মাণ করতে গেলে স্থপতি ও কাঠামো প্রকৌশলীসহ সকলকে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করতে হয়। যাতে বিল্ডিংয়ের আকার-আকৃতি ও সকল নকশা ভূমিকম্পের জন্য যথাযথ ও সাহচর্যপূর্ণ হয়। কারন অনিয়মিত আকারের বিল্ডিং ভূমিকম্পের জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং সঠিক কাঠামো নকশা করার পরেও তার ভূমিকম্পকালীন সময়ে পারফর্মান্স ভালো নাও হতে পারে।

সঠিকভাবে বিল্ডিংয়ের নকশা প্রনয়ন হচ্ছে কিনা এই কাজটা তদারকির দ্বায়িত্ব পড়ে ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে স্ব স্ব উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, পর্যাপ্ত কারীগরি জ্ঞানসমপন্ন জনবলের অভাবে এই কর্তৃপক্ষগুলো বিল্ডিং নির্মানের পূর্বে শুধুমাত্র স্থাপত্য নকশা যাচাই করে অনুমোদন দিয়ে থাকেন। কিন্তু বিল্ডিংয়ের ভূমিকম্প সহনীয়তা যেই কাঠামো নকশার গুনগত মানের উপর নির্ভরশীল তা কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা ও যাচাই বাছাই ছাড়াই অনুমোদিত হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে অনেকসময় এই কাঠামো নকশা একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ ও এখতিয়ারভূক্ত অঞ্চলে নিবন্ধিত কাঠামো প্রকৌশলী দ্বারা প্রনয়ন করা হয়না। অনেক সময় খরচ বাচানোর জন্য, আবার অনেক সময় প্রকৌশলীর প্রায়োগিক কারিগরী জ্ঞানের অভাবে দুর্বল নকশার অনেক বিল্ডিং , ব্রীজ ও অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ হয়। এই স্থাপনাগুলো ভূমিকম্পের জন্য মৃত্যুকুপ হিসেবে কাজ করে। কারন একটা ভয়াবহ ভূমিকম্পে এই ভবনগুলোর অনিয়ন্ত্রিত ধ্বসের কারনে লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ যেতে পারে।

গত ২০০ বছরে ঢাকায় ১৫ টির বেশী বড় মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ১৮৯৭ সালে রিখটার স্কেলের ৮.১ মাত্রার গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পের কেন্দ্রভূমি ঢাকা থেকে মাত্র ২৩০ কিলোমিটার দূরে ছিল। এতে রংপুর , জামালপুর ও সিলেটের অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৮৮৫ সালের ৭ মাত্রার বেংগল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বগুড়া। ১৯১৮ সালের ৭.৬ মাত্রার শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পে সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গলের অনেক বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও ধ্বসে পড়ে । ১৯৯৭ সালের ২১শে নভেম্বর বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তস্থলে সৃষ্ট ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে চট্রগ্রামে একটি নির্মাণাধীন ভবন ধ্বসে পড়ে বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু হয়। সম্প্রতি ২০০১ সালে ঢাকার নিকটবর্তী অঞ্চলে ৪ মাত্রার ভূমিকম্পে জনমানুষের মধ্যে ব্যাপক আতংক ও ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলের অনেকে বন্দী আহত হয়।

বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকায় বর্তমানে মোট ভবনের পরিমাণ প্রায় ৩,৬০,৫০০ টি। যার অধিকাংশই আবাসিক, বাকীগুলো বানিজ্যিক ,শিল্পকারখানা ও অন্যান্য শ্রেণির ভবন। ঢাকায় প্রায় ১১৪ টি ব্রীজ, ২৮ টি সুউচ্চ জলাধার, ২১৪৯ টি স্কুল ও ৪৮৭ টি হাসপাতাল রয়েছে । এসব স্থাপনাগুলো সঠিক নকশায় ভূমিকম্প সহনীয় হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ যা যথাযথ পরীক্ষা নিরীক্ষা ও কারীগরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নির্ধারন করতে হবে।

এই ধরনের ভয়াবহ দূর্যোগ পরবর্তী অবস্থায় উদ্ধার কার্যক্রম ও চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য দরকার দক্ষ জনবল। আমাদের এইধরনের ভয়াবহ দূর্যোগের জন্য যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহন করতে হবে। সরকার কর্তৃক নির্মিত স্থাপনার পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকাধীন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যেন সামান্য খরচ বাঁচাতে গিয়ে অনভিজ্ঞ স্থপতি ও প্রকৌশলীর দ্বারা সঠিক মৃত্তিকা পরীক্ষা ব্যতিত, বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নকশা বা ডিজাইন প্রণয়ন করে ও যথাযথ গুনাগুনসম্পন্ন নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার না করে যেন কোন ভবন নির্মাণ না হয়। আমাদের সচেতনতা ও পূর্বপ্রস্তুতিই পারে যেকোন দূর্যোগকে সঠিকভাবে মোকাবেলায় সক্ষমতা তৈরী করতে।

(সংযুক্ত ছবিটি নেপালের একটি বিল্ডিং ধসের ছবি The Guardian এর সৌজন্যে)